বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। দেশের প্রায় নব্বই ভাগ নাগরিক মুসলিম। স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম সহানুভূতির যে চিন্তা লালন করে, এদেশের মানুষের মাঝে তা প্রতিফলিত হবে। কোনো ক্ষেত্রেই জিম্মি করে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করা হবে না।
কিন্তু দেখতে হচ্ছে ভিন্ন চিত্র। বিগত সময়ে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে অস্তিরতা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এবার রমজানের বাইরেও এ-ভোগান্তির সীমা বিস্তৃত হয়েছে। পেঁয়াজ, চাউল ও আদা-রসুন সহ নিত্যপণ্য নিয়ে সাধারণ মানুষ যে কারসাজির শিকার হয়েছে, এরপর দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে অবশ্যই আমাদের লজ্জা হবে।
সম্পদের ব্যাপারে ইসলামের দর্শন হচ্ছে, এগুলোর মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি কাউকে অনুগ্রহ করে এর মালিক বানান। তাছাড়া কোনো প্রাণীকে সৃষ্টির আগেই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তার রিজিকের ব্যবস্থা করে থাকেন। তাই তো আমরা দেখতে পাই বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মায়ের স্তনে দুধ এসে যায়। অন্যদিকে বাহ্যিক কোনো উপকরণ গ্রহণ ছাড়াই খেয়ে বেঁচে আছে জীবের সংখ্যাই দুনিয়াতে বেশি। এটা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার অলঙ্ঘনীয় বিধান, যার ঘোষণা এসেছে আল কোরআনে। বলা হয়েছে, ‘জমিনে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে সকলের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর।’ (সূরা: হুদ, আয়াত: ৬)।
আল্লাহ তায়ালা দয়া করে মানুষের রিজিকের ব্যবস্থা করে দিলেও, কিছু সংখ্যক অসাধু মানুষ দ্বারা তা বাধাগ্রস্থ হতে পারে। যেমন আমাদের পরিবেশের ক্ষেত্রে হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের বসবাসযোগ্য করে এই পৃথিবীটাকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষের অপকর্মের দ্বারা আজ পৃথিবীটা আমাদের বসবাসের উপযোগী থাকছে না। এ ব্যাপারেও আল কোরআনে তথ্য আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ, মানুষ স্বহস্তে যা কামাই করেছে (তা)। (উদ্দেশ্য) যাতে আল্লাহ তায়ালা ওদের আস্বাদন করান ওদের কৃতকর্মের কিছুটা শাস্তি।’ (সূরা: রুম, আয়াত: ৪১)।
বর্তমান পরিস্থিতে আমাদের উপলব্ধি হওয়া দরকার যে, মানুষের সংখ্যা বেশি হলেই খাদ্যের সংকট হবে তা কিন্তু নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আগের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু না খেয়ে মারা যাওয়ার সংখ্যা কমছে। বর্তমানে যোগানের পর্যাপ্ততার দরুণ দেশের মানুষ আরো শান্তিতে বসবাস করতে পারতো। এক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মজুতদারি ও সিন্ডিকেট। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে মজুতদারি, সিন্ডিকেট রোধে আমাদের বেশি মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গেছে। অথচ মালে গোডাউনগুলো তখনো ভর্তি ছিল। খাবার বিলি-বন্টন না করে তা যুদ্ধের জন্য রিজার্ভ রেখেছে। বর্তমানেও পেঁয়াজে গোডাউন ভর্তি কিন্তু কম দামে বিক্রি না করে পচাচ্ছে। অথচ মানুষ পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি খাচ্ছে।
আল কোরআনে ব্যবসার আলোচনা:
সরাসরি ব্যবসার আলোচনা আল কোরআনে ছয়টি মতো সূরাতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ব্যবসা বলতে আখেরাতের ব্যবসা বুঝানো হয়েছে কয়েকটি সূরাতে। কয়েকটিতে এসেছে দুনিয়ার ব্যবসার আলোচনা। যেমন বলা হয়েছে ‘ (তারা) এমন সব লোক, ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় তাদের গাফেল করে না আল্লাহর স্মরণ, নামাজ কায়েম ও জাকাত প্রদান থেকে।’ (সূরা: নূর, আয়াত: ৩৭)। এখানে ব্যবসায়ী দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম উদ্দেশ্য। সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশ ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
অন্যত্র বলা হয়েছে ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে তোমাদের পরস্পরে সম্মতিক্রমে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য হলে।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ২৯)। ব্যবসার ক্ষেত্রে শর্তযুক্ত হয়েছে পরস্পর সম্মতি থাকা। জোর-জবরদস্তিমূলক ব্যবসা হলে অন্যের মাল বৈধ হবে না। সূরা: জুমাতে এসেছে ‘(তোমাদের মধ্যে কতক এমন যে) তারা যখন বাণিজ্য বা কোনো খেল-তামাশা দেখে তখন সে দিকে ছুটে যায় এবং আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে যায়।’
সূরা তাওবাতেও তেজারতের আলোচনা এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহ বিধান ও রাসূল (সা.) এর আদর্শ থেকে কারো কাছে ব্যবসা বেশি প্রিয় হলে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করতে।’ সূরা বাকারাতেও ব্যবসার আলোচনা এসেছে। উল্লেখ্য, ব্যবসার আলোচনায় আল্লাহ তায়ালার স্মরণ বলতে বুঝানো হয়েছে, তার দেয়া বিধান। অর্থাৎ ব্যবসার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলতে হবে। অতি মুনাফার লোভে খোদার বিধানকে লঙ্ঘন করা যাবে না।
সরাসরি ব্যবসা শব্দে না হলেও অন্য শব্দে ব্যবসার আলোচনা এসেছে কোরআনের আরো বহু জায়গায়। যেমন সূরা জুমাতেই বলা হয়েছে, ‘যখন নামাজ আদায় হয়ে যায় তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়।’ সূরা মুজাম্মিলে বলা হয়েছে, ‘অন্য একটি দল দুনিয়াতে ভ্রমণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশের উদ্দেশ্যে।’ সূরা কাসাসে বলা হয়েছে ‘তুমি তালাশ করো আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে যা দিয়ে রেখেছে এবং দুনিয়াতেও তোমার অংশের কথা ভুলো না।’ মোটকথা আল কোরআনে ব্যবসা, ব্যবসার নীতি ও ব্যবসা করে মানুষের ওপর ইহসান করার প্রসঙ্গ আলোচনা হয়েছে।
যে ব্যবসায়ীদের ওপর রাসূল (সা.) লানত করেছেন:
হজরত ওমর (রা.) এর সূত্রে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণীত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের জন্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অন্য এলাকা থেকে পণ্য এনে বিক্রি করবে সে রিজিক পাবে, আর যে পণ্য মজুতদারি করে রাখবে সে লানতপ্রাপ্ত হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ ও দারেমী)। হাদিসে প্রথম শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ! আর দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য দু:সংবাদ! রাসূল (সা.) যার ব্যাপারে লানতের ঘোষণা দিয়েছেন তার চেয়ে হতভাগা কে আর হতে পারে! এখানে শুধু লানতের বিষয়ই নয়। বরং মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, লানতের সঙ্গে সঙ্গে তার রিজিকের সরবরাহও কমে যাবে। এর দ্বারা বাহ্যিক অর্থও উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার রূপক অর্থও উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ সম্পদের দ্বারা উদ্দেশ হলো সুখ-শান্তি। ব্যবসায় অসৎ পন্থা অবলম্বনের কারণে সম্পদ থাকা সত্বেও সে অশান্তিতে থাকবে।
পাঠকের মতামত